উদ্ভাস

১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, অক্টোবর ২০১২

এপ্রিল সংখ্যা, ২০১২

সম্পাদকীয়

প্রতিশ্রুতি আর প্রতীক্ষা এখন নির্ভেজাল সত্য উজ্জ্বল মুহূর্তে। স্বাগত "উদ্ভাস"- সৃজনশীলতার রত্নচাষ আর নয় আবদ্ধ মনোভূমিতে। খুলেছে সুদৃশ্য পর্দা। ঝিনুকের অবগুন্ঠনে সুপ্ত প্রতিভার ঝলক, তুবড়ির স্ফুলিঙ্গে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক এবার আপনাদের বিরল প্রতিভার স্বাক্ষরে। কাব্যপ্রতিভা সঠিক রূপ নেয় কবিতায়, গল্পে, রম্য রচনায়। শব্দের উপর নান্দনিক প্রলেপ ছত্রে ছত্রে কবিতাকে রূপসী গড়ে, তেমনি নিপাট গদ্যময়তা গল্প, রচনায় অনন্য মোহে আচ্ছন্ন করে। চেতনায় প্রত্যয় জমাট বাঁধে। সম্পূর্ণতা আজও অধরা মানুষের। সেই খামতি অনুঘটক হয়েজারিত হয় মেধার উন্মেষে। রোজকার কষ্টের বুদবুদ কর্পূর-ধর্মে বাতাসে মেশে কাব্যরসদে। এই একাকীত্বের প্রাকৃতিক ভর্তুকি মানুষ খোঁজে তাঁর মন-মজ্জার শোণিতে, শব্দখচিত সাহিত্যজহরে। অগণিত মুক্ত অক্ষর নিসর্গের সহোদর রূপে ঘূর্ণায়মান রচকের চেতনায়। অঝোর ধারায় যখন বৃষ্টি আদর করে হাওয়ার উদ্দাম শরীর, কবি তখন তাঁর মনের ক্যানভাসে এঁকে চলে শব্দবাহার, শ্রবণে যা মূর্ছনায় আপ্লুত করে ধ্বনিবাহার। আবার, গ্রীষ্মের শুষ্ক অবয়বে স্থূল সময়ের উত্তাপে রচিত হয় কলমচির অনবদ্য শৈলী সাহিত্য। সময় বড়ো নির্মম, দ্রুত গিলে নেয় অধিগত মূল্যবোধ উত্তরোত্তর প্রজন্মের। মানুষের সুখাভিলাষ অনেক যন্ত্রঘেঁষা, কলাবৃত্তি সংখ্যাপ্লতায় আচ্ছন্ন। মুষ্টিমেয় শব্দচাষী আজ অনেক আদরণীয়। তাঁদের সংস্পর্শ অতএব ছুঁয়ে যাক আরো বহুল পরিমাণে শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষকে। কলমের ধার বাড়ে নিরন্তর কলা আরাধনায়। সার্থকতা শ্রদ্ধা পায় বিনা তোয়াজে, অনায়াস শৈলী সৃষ্টিতে। মনের এমনতর শিল্পচেতনা শব্দঝরনায় প্রস্ববিনী হয় নিশ্চিতভাবেই কোন শব্দাধারে। এমনি হর্ষোদ্বেল মনোরম তপোবন এই অসাধারণ ব্লগ.."উদ্ভাস"..!
কাব্যবোধ যার সহজাত বৈশিষ্ট্য তাঁর কাছে সাহিত্যের যে কোন শৈলী সহজসাধ্যের উদাহরণ। প্রত্যেক সদস্য সেই প্রতিভার দাবী রাখেন। প্রয়োজন শুধু বোধনের। অতএব আসুন। আর ইশারা নয়....আপাদমস্তক কাব্যলহর স্বকীয়তায়, ঝলমলিয়ে উঠুক "উদ্ভাস"-এর ইন্দ্রবাসরে ।





রঙিন নুড়ির রাজা
শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

ধুলোর কোমল হাতে রেখেছি শৈশব আর গাছপালা
আড়াল করে ঘিরেছে অভিমান। পেয়ারা গাছের নীচে,
করবীর পাশে নীচুমুখে কাদাজল মাখি, রাখালপুতুলের
কল্পশরীর ছুঁয়ে থাকে রৌদ্র পাতার ঝিলিমিলি;
বালক রাখাল গড়া হলে, তার হাতে বাঁশি দিতে চাই
সুরের অথই ভার বারবার ভেঙে মাটিতে মিশে যায় মাটি
কাপড়ে চোরকাঁটা বেঁধা, ওই যে গাভী আর রাগিণীর সখা
ও কি তবে চুপিচুপি ফুঁ দেয় পৃথিবীর বুকে? অমনি পলকে
হাজার রন্ধ্র খুলে জেগে ওঠে শ্যামল সবুজ সব রাগ
ফুলে ফুলে ঘোর, ঘুমন্ত শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে প্রহরায়
চেয়ে দেখে লাবণ্যধারা বয়ে যায় মুখ থেকে সীমাহীন মুখে,
তাদেরই পত্রপুটে আদরে ধরে রাখে শাসন পালানো
একলা বালকের সারি সারি নিঝুম দুপুর?

রাজা, কথা ছিল ঠিক আসবেই আজ। এসে গড়ে দেবে
আমার রাখালের বাঁশি; পৃথিবীর সব মাটি, জলাশয়
সমস্ত চঞ্চল সুর, বৃক্ষদেবতা, তোমার কথাই শুধু শোনে

২।

তোমার রথের ঘোড়াগুলো বুঝি দৌড়ে পালিয়েছে আজ?
দিগন্ত ছুঁয়ে নেমে গেছে বালকবালিকার মাঠে, যার পাশ দিয়ে
হেঁটে যায় একসারি ডুরেশাড়ি বৌ, কলসি ও কাঁখ?
রাজা, সন্ধ্যায় নদীর গন্ধ মিশে এলে, তোমার কথা বড়ো মনে পড়ে
ফুলের আঙিনা দুইহাতে খুলে ঝুঁকে পড়ে দেখি নতুন ঘ্রাণের রূপে
তুমি এলে কিনা, পরাগের লাজুক পথ যদি আলো হয়ে ওঠে

পেয়ারাতলায় একা পড়ে আছে আমার রাখাল, তার হাত ফাঁকা।
আকাশজুড়ে মহিষের মতো সন্ধ্যামেঘেরা ফিরছে বাথানের পথে,
শুধু বাঁশি নেই বলে এখনও রয়ে গেছে বালক রাখাল।
তুমি একবার এসে ওকে দেখো। দেখো ওর চোখের কাজল
মুছে যায় অশ্রুর জলে। যদি তোমাকে দুষ্টুমি করে বেঁধে রাখি
আমাদের করবীর ডালে, তবে বলো, কীভাবে পাখিডাকা ভোর
আর আলোর পদ্ম হবে পরের সকালে?



বদনাম 
অর্পিতা দাশগুপ্ত


চুম্বনের চাপে আজ আমার হৃদয়ে
ভালবাসার কষা স্বাদ
তোমার উৎপীড়ন
সহ্যের সীমা পার করেছে ।
কেন ----
আমার জঠর বদনামের ভাগীদার ,
এতো তেঁতো তোমাকে ভালোবাসা ?
যা আমাকে নিয়ে তুলেছে পতিতা পল্লীর আশ্রয়ে ।



বন্ধুত্বের  আবদার
দেবাশিস  দে



সোহম প্রথমে বুঝতেই পারেনি। অবাক হয়ে তুহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।  কিছু বলতে  পারে না, তুহিন যে  এরকম  আবদার  কোনোদিন  করতে পারে সোহম  কল্পনাতেও  তা ভাবতে পারেনি।
             তুহিন-অঙ্কিতার পাঁচ বছরের  স্বামী  স্ত্রীর সম্পর্ক । সোহম  আর  তুহিনের  বন্ধুত্ব ছোট বেলা থেকে। একসঙ্গে সব ক্লাশ পার করে তুহিন এখন আই টি  প্রফেশনাল,  আর  সোহম  বিদেশী এক  কোম্পানীতে  জুনিয়ার  অফিসার।
             অফিস ছুটির পর বাডি ফিরে দুই বন্ধুর রোজ দেখা হওয়া চাই। ছুটির দিন হলে তো আর  দুই বন্ধুকে পায় কে ? ছোট বেলা থেকে একই রুটিন। কিন্তু কিছুদিন থেকে সোহম খেয়াল করে তুহিন যেন খুব অন্যমনস্ক । জিজ্ঞাসা  করলেও সঠিক উত্তর পায় না সোহম । তবে কিছু  একটা বলতে  গিয়ে  তুহিন বার বার থেমে যায় - সোহম তা বুঝতে পারে।
             তিন  বছর  এ  ডাক্তার ও  ডাক্তার  করে  কোনো লাভ হয় না। তুহিন বাবা হতে পারে না। অঙ্কিতার দিকে তাকালে তুহিনের  নিজেকে অপরাধী  মনে হয় ।  গত শনিবার  ডাঃ মিত্র  তুহিনকে জানিয়ে দেয়
- না,  কোনদিন  সে আর বাবা  হতে পারবে না।
অনেক ভাবনা চিন্তার পর  তুহিন  সোহমের কাছে আঙ্কিতার গর্ভে  তার  সন্তান আবদার  করে ।




দ্রোহমুক্তি
অস্মা অধরা

দিনে দিনে বড়ই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে শব্দেরা আমার ....

শব্দের বুক চিরে বেরোয় প্রতিবাদী ভাষা....
আমার ডান অলিন্দের দেয়ালে দেয়ালে মারছে পোষ্টার
আর বাঁ অলিন্দের গলিতে মিছিল !!
বন্ধ করে দিচ্ছে আর্টারি
শ্লোগানে মুখর পুরো ক্যাম্পাস....।।

দুঃখ শব্দগুলোকে চা নাশতা খাইয়ে বলেছিলাম, এখানে থাকো বসে ;
টিভি তে দুর্ধর্ষ টকশো হচ্ছে...দ্যাখো !!
একটি ভ্রু ঈষৎ উঁচু করে সে দেখলে আমাকেই !!

ক্লান্ত শব্দগুলোকে আমার বেডরুমটা ছেড়ে দিয়েছিলাম !
বললাম ঘুমাও একটু তোমরা,
ক্লান্তি কেটে গেলেই নিয়ে যাবো সাথে; পাড়ি দেবে
অসীমের পথ আমার !
সেও কিনা কাত হয়ে থেকে দেখলে আমাকেই !!

কামুক শব্দগুলোকে বললাম, সমাজটা ভালো নয়
তোমাকে তেড়ে আসবে এক্ষুনি !!
থাকোনা চুপ করে, বসে বসে পাজল্ খেলো !
সারা মুখে বার্থ রাগ আর হতাশায় মাখামাখি হয়ে
সেও কিনা ঘুরে দেখলে আমাকেই !!

এমন আরও কত যে শব্দেরা আমার, হীন শব্দ,
লীন শব্দ , অভিমানী গাল ফুলানো আর পরাজিত হেরে যাওয়া শব্দ !!
বার্থ প্রেমে হেরে যাওয়া
নেশাখোর শব্দ ,
ধর্মের দোহাই দেয়া কিছু ভণ্ড শব্দ ,
সবাই আজ আন্দোলনে মুখর !!

ক্রমশ: হেরে যাই শব্দবিপ্লবের কাছে...
'এই মেয়ে!! শুধু ভালবাসার কথা লেখো কেন তুমি ??'
আজ থেকে মুক্ত করে দিলাম সব শব্দদের আমার !!

আর নেই বাধা হবে শব্দ নির্যাতন,
হবে শব্দ মনন, হবে শব্দ যৌনাচার,
হবে শব্দ অপহরণ !!

শব্দদ্রোহে হয়ে যাবে আজ ভালবাসার মরণ !!


শুভন্ময়
দিবাকর সরকার

লম্বা নখের মাথায়
ঘাম এসে ডাকপিয়নের মত।

শয্যা থেকে কোমর
মুচড়ে নেয় বিছানার উপনিবেশ।

তোমার জন্ম তিথি
বেঁচে যাক বেঁচে থাক অগ্রগামী।

অযথা হরমোন গুলো
লাফিয়ে উঠুক উচ্চ থেক উচ্চতায়।




সংস্কার
মৌ দাশগুপ্ত 

কিশোরীমোহন ভট্টাচায্যি খুব সাত্ত্বিক ব্রাহ্মন, ত্রিসন্ধ্যা গায়েত্রী জপ না করে জলগ্রহন করেন না, কথায় কথায় সংস্কৃত শ্লোক আওরান,তাঁর উপস্থিতিতে অন্য স্থানীয় পূজারীরা ভূল মন্ত্রে বা ভুল উচ্চারণে পূজো করতে সাহস পান না. নিজের বাড়ীতে প্রতিষ্ঠিত গৃহদেবতার ষোড়শপচারে পূজো করলেও অন্যত্র একাধিকবার সনির্বন্ধ অনুরোধ স্বত্তে যজমানিতে রাজি হননি. কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে খুব যে গোঁড়া তা নন, নিজে মানেন অনেক কিছুই কিন্তু অন্যকে কোনদিন কোনভাবে প্রভাবিত করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না. কোন কারনে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে ভদ্রলোকের উৎসাহটা বেশী,তাই ও বিষয়ে পুঁথিগত জ্ঞানটাও লক্ষ্য করার মত, শুধু বেদ বা গীতাই নয়, সমান অনায়াস দক্ষতায় তিনি একই ভাবে কোরান শরীফ, বাইবেল কিম্বা গ্রন্থসাহিব থেকেও যথোপযুক্ত উদ্ধৃতি তুলে আনতে পারেন।মাইথোলজি বা উপকথার কাহিনীতেও তার জানার পরিধী রীতিমত ঈর্ষনীয়। অতএব,পেশায় সরকারী চাকুরে কিশোরীমোহনবাবুকে আশেপাশের লোক রীতিমত সমীহ করে চলে.তবে, সে ওনার মিতভাষী স্বভাবের জন্য, নাকি ওনার পান্ডিত্যের খাতিরে, কি রাশভারী ব্যক্তিত্বের জন্য অথবা অফিসের তকমাদার পদের জন্য সেটা বলা মুশকিল। ওনার অফিসের সহায়ক বিকাশ বয়সে কাঁচা, সবে কলেজের পাট চুকিয়ে চাকরীতে ঢুকেছে, খুব চটপটে আর করিৎকর্মা.মিশুকে এবং আলাপী বিকাশ অল্পদিনেই সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে.তা হঠাৎ করে এই হাসিখুশী ছেলে কেন যে প্রচুর পরিমানে ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরার যোগাড় করছিল কে জানে!সঠিক কারনটা এখনও কেউ জানেনা.অনেকে অনেক রকম অনুমান করছে এবং সেইমত জোরদার আলোচনাও চলছে, কিন্তু কারো ধারনাই কারো কাছে গ্রহনযোগ্য হচ্ছেনা.এমনসময়ে জানা গেল কারন আর কিছুই না. কাঁচাবয়সের প্রেম. মেয়েটি নাকি ওর সহপাঠিনী,দীর্ঘদিনের আলাপ,সেখান থেকে বন্ধুত্ব,অবশেষে প্রেম.আর সমস্যাটি হল এই যে, জন্মসূত্রে মেয়েটি ভিন্নজাতের শুধু নয়, সঠিকভাবে বলতে গেলে ভিন্ন ধর্মের. বিকাশের মা নেই,ঠাকুমার কাছে মানুষ,কিন্তু সেই ঠাকুমাই একদম বেঁকে বসেছেন. রীতিমত অন্নজল ত্যাগ করে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে রেখেছেন এবং বলাই বাহুল্য যে মেয়েটির ঘরেও কমবেশী একই প্রতিক্রিয়া, ওরা তো উল্টে সাত তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা করতে ব্যস্ত.অতএব ঘরে বাইরে চাপ সামলাতে না পেরে এই হঠকারী সিদ্ধান্ত । খবরটা শোনার পর থেকেই কিশোরীমোহনবাবুকে আশ্চর্য্যজনক ভাবে বিচলিত দেখা গেল,চাপা স্বভাবের লোক কিনা, তাই কেউ বুঝতে পারে নি যে বিকাশকে উনি কতটা ভালোবাসতেন.যদিও সময়মত হাসপাতালে  নিয়ে যাওয়াতে ছেলেটা প্রাণে বেঁচে গেছে কিন্তু কিশোরীমোহনবাবু ঠিক যেন স্বস্তি পাচ্ছেন না.অবশেষে সাত পাঁচ ভেবে একদিন একাই চলে গেলেন বিকাশের বাড়ী, বিকাশ তখন সদ্য ফিরেছে হাসপাতাল থেকে, বেচারা তো হঠাৎ করে কিশোরীমোহনবাবুকে আসতে দেখে হতভম্ব.। কিশোরীমোহনবাবু কিন্তু বকাঝকা উপদেশ কোনকিছুরই ধার ধারলেন না,যেন বিকাশ এই সবে জন্ডিস কি টাইফয়েড থেকে উঠেছে এরকম মামূলী দু’একটিকথা বলতে বলতে বেশ যেন আড্ডার মেজাজে গলা ঝেড়ে বিকাশের বাবাকে বললেন, -“মন খারাপ করবেন না মুখুজ্জেমশাই, বরং একটা গল্প বলি শুনুন.সে আজকের কথা না,পূববাংলা পশ্চিমবংলা তখনও ভাগ হয়নি,সে সময়ে ঢাকার শহরতলীতে কবীর আর রাধামোহন নামে দুই বন্ধু ছিল. ছোটবেলার বন্ধুত্ব কিনা, ধর্ম বা কর্মে বাঁধ সাধে নি, সমবয়সী দুই বন্ধুর স্ত্রীদেরও গলাগলি ভাব. রাধামোহনের ঘর আলো করা দুবছরের রাই আর কবীরের ঘরে একমাসের করিম.ঠিক তখনই দেশ জুড়ে ঝাপিয়ে পড়ল সাম্প্রদায়িকতার ভূত.ধর্মের নামে কিছু মানুষ সম্পর্ক ভুলে যেন নৃশংস হত্যালীলায় মেতে উঠলো,ধনী গরীব , বাচ্চা বুড়ো, মহিলা পুরুষ, কেউ সে আগুন থেকে রেহাই পেল না. এই রকমই একদিন, রাধামোহন লুকিয়ে শহরে গেছিল পরিবার সমেত ভিটেমাটি ছেড়ে যাবার প্রয়োজনে বাহনের ব্যাবস্থা করতে, ঘরে রাইকে নিয়ে রাইয়ের মা কমলা,সাথে কবীরের বিবি আরশি,তখনই হানা দিল খুনী হায়েনার দল.বন্ধুর ঘরের বন্ধ দরজা আগলে প্রতিরোধ তুলেছিল কবীর, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি, হানাদারদের গুলিতে স্বামীকে লুটিয়ে পড়তে দেখে আর্তচিৎকার করে ছুটে গেছিল কবীরের বিবি আরশি, হানাদাররা তাকেও রেয়াত করেনি. প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এই হট্টগোলের মধ্যে রান্নাঘরের বাঁশের বেড়া ভেঙ্গে কোলেকাঁখে দুটো বাচ্চা নিয়ে পুকুড়পাড়ের কচুবনে লুকিয়ে পড়েছিল কমলা, অনেক রাতে সেখান থেকেই তাকে উদ্ধার করে রাধামোহন ও তাদের আরো কিছু নিরুপায় শুভার্থী প্রতিবেশী.তখন ভয়ভীতিতে সে প্রায় অর্ধোন্মাদ. সেখান থেকে কিভাবে ওরা মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ী এসে পৌঁছায় সে এক ইতিহাস আর নতুন জীবন কাহিনীর শুভারম্ভও বটে.। ফেলে আসা বসত, ফেলে আসা ভিটে, ফেলে আসা দেশ, ফেলে আসা মানুষজন,ফেলে আসা স্মৃতি সব তখন বিভীষিকা বই কিছু নয়, তাই করিমকে আর ফিরিয়ে দেওয়া যায় নি তার আত্মীয়দের কাছে,রাধামোহন কমলার ছেলে, রাইয়ের ভাইয়ের পরিচয়েই সে বড় হয়ে উঠেছে, পরিচিতি পেয়েছে, এমনকি হিন্দু ব্রাহ্মন ঘরের সংস্কার অনুযায়ী তার যথাসময়ে উপবীত সংস্কারও হয়েছে. রাধামোহন এ ব্যাপারে কোন অন্ধ ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দেন নি, মহর্ষি উদ্দালক আর জবালার উপাখ্যান শুনিয়েছেন কমলাকে,বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন যে ধর্ম মানুষের জন্মজাত সংস্কার নয়,ওটা সামজিক সংস্কার মাত্র. ব্রাহ্মন রাধামোহন করিমকে নিজের ছেলে বই কিছু মনে করেন না, তাই ব্রাহ্মণ্যরীতিতে উপবীত সংস্কারও করাবেন, তবে হ্যা, বড় হয়ে,সাবালক হয়ে, করিম যদি তার নাম পরিবর্তন করাতে চায়,তবে তাতেও তিনি বাধা দেবেন না.” বলতে বলতেই উৎসুক শ্রোতাদের নীরব জিজ্ঞাসু চাউনী র সামনে হয়ত বা কিছুটা আত্মস্থ হবার সময় নিলেন, একটু থেমে, শ্রোতাদের ওপর এক এক করে নজর ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, -“ধর্ম,পদবী,পরিচয় সব তো মানুষের তৈরী, কিন্তু মানুষ? মানুষ কিন্তু সেই উপর-ওয়ালার দান, সেখানে কারো খোদকারি চলে না, ধর্ম নিয়ে কম জিজ্ঞাসা তো ছিল না আমার, কিন্তু যা পড়লাম বা শিখলাম, তাতে কোন ধর্মই মানুষকে অন্ধ বানায় না, বরঞ্চ মানুষই ধর্মকে অন্ধ অনুসরণ করে নিজে সেধে অন্ধ সাজে, বাবা বললেও আমি কিন্তু এখনও তাই নাম পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি নি, বাইরে সবাই আমাকে ঈশ্বর রাধামোহন ভট্টাচায্যির ছেলে কিশোরীমোহন ভট্টাচায্যি বলে জানলেও আমার অশীতিপর বৃদ্ধা মা কিন্তু এখনও আমায় আদর করে করিম বলেই ডাকেন.”

* (একটি সত্য ঘটনর ছায়া অবলম্বনে… “কিশোরীমোহন ভট্টাচায্যি” এই অলীক নাম ও পরিচয়টির আড়ালে আমার এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের জীবন কাহিনীর খন্ডাংশমাত্র লিপিবদ্ধ করলাম, ব্যক্তিগতভাবে এ কাহিনী করোর ভাবাবেগকে আহত করে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।।)





আমার মুখের কথা
অলোক বিশ্বাস


পাহাড়ের গায় যে ছবি আঁকলাম আজ
সেও মূর্তি হয়ে গেছে প্রেম ও করুণায়

হৃদয়ের ঝড় ভেঙে দিলে মগ্নধ্যান, তোমাকেই খুঁজে চলি
অনন্ত স্রোত। আমাকে পার করো ভালোবেসে।
সুগন্ধি বাতাসকে বলেছি স্বদেশে অরণ্য চাই, বসন্তের গানে গানে
কোকিলেরা রোদ্দুরে পোড়াক ঘৃণা।

অন্ধকার ফুটো করে ফোটাবো ফুল
আমাকে ভেজাও বৃষ্টি, ভেজো এলোচুল।

আমারই মুখের কথা জানি একদিন মন্ত্র হয়ে যাবে,
লবণে পুড়ে পুড়ে রাত তোমাকে বলবে সুন্দর।

অবিশ্বাস বেড়ালের নূপুর
কচি রেজা

উপেক্ষার দীর্ঘ বেলায় সব প্রতীক্ষাই যখন পাথর তখন চিত্রিণী বৃক্ষগুলো শ্রাবণ হেঁটে আসে,
নীল শাড়ির আঁচলে নিঃশ্বাস নাচে আর বুনো হাঁস ওড়ে বেহুলার মতো,
শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে যখন গানগুলো এক একজন রবীন্দ্রনাথ তখন থেমে যাওয়া আমার
ভেতর যে-অন্ধকার তাকে গান শোনাতে চেয়েছিলে তুমি ?বৃষ্টির পেছনের বেদনা কতবার কালিন্দী
নদীতে বাঁশি হয়েছে জান?ছেঁড়া নূপুরের তারে যতক্ষণ নেচেছিল বেহুলা ততক্ষণ সে রক্তকরবী,
ততক্ষণ তার হরিণী পায়ে আটকে ছিল চন্দ্রবোড়ার চোখ,
স্বীকারোক্তিতে সত্যিকথাই বলেছিলাম সেদিন,যে কদমফুল সে বৃষ্টি হোক,যে নিজেই কদম সে
কেয়াপাতার নৌকো,আমার নীল শাড়ি খুব একা তবু রাধা হতে পারে না জান তো?মাঝে মাঝে
খোলা হাওয়ায় গান হয়ে বাইরে যায় আমার শাড়ি,
ঘোর লাগা একা এক মেয়ে সাপ চিনতে পারে না,যেদিন বুনোহাঁস সাদা হয়েছিল ওই চোখে আর
গলায় পাথর বেঁধে নেমে এসেছিল চাঁদ ওই কলঙ্কে ডুববে বলে,

সেদিন যতদূর বাঁশি ততদূর বাঁকা তার শরীর।



আমার মন কেমন করে
শ্রুতি চৌধুরী


তোর ছোটবেলা মনে পড়ে?কি জানি কদিন খালি ঘুরে ফিরে আমার মনে ছোটবেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে।তোরও নিশ্চয় মনে পড়ে।আমাদের ছোটবেলা তো বেশি দূর নয়,আট দশ পা পিছিয়ে গেলেই তো পৌঁছে যাওয়া যায়।আচ্ছা সেই এক্কা-দোক্কা,কুমির ডাঙ্গা খেলার কথা তোর মনে আছে?তোর বন্ধুরা তোকে খুব খেপাত আর আমার ওপর রেগে গিয়ে বলতিস কাল থেকে আর তোর সাথে খেলবো না,কিন্তু বিকেল হলেই ঠিক চলে আসতিস।আর সেই দিন টার কথা?জানুয়ারি মাস ছিল তাই না?খুব ঠাণ্ডা।আমি তো সোয়েটার টুপিতে একটা বল হয়ে তুই আর দাদুর সাথে দশাশ্বমেধ ঘাটে বসেছিলাম।হঠাৎ তোর কি খেয়াল হল বললি চল প্রদীপ ভাসাই।দাদুর কাছে পয়সা নিয়ে প্রদীপ কিনে ঘাটে নামলাম আর তারপর............তারপরই চিত্তির, পা পিছলে এক্কেবারে জলে।ভাগ্যিস ঘাট ভর্তি লোক ছিল হৈ হৈ করে তুলে ফেলল আর আমি তখন ঠাণ্ডায় কাঁপছি ঠকঠক করে ,সোয়েটার শুদ্ধ ভিজে একেবারে পান্তুয়া আর তুই.....বাড়ি ফেরার পথে সারা রাস্তা হেসেছিলি আর কেমন করে পড়ে গিয়েছিলাম তাই অঙ্গভঙ্গি করে দেখাচ্ছিলি।আমার খুব কান্না পাচ্ছিল কিন্তু একটুও কাঁদিনি শুধু বাড়ি ফেরার সময় তোর দিকে না তাকিয়েই আড়ি বলে ঢুকে পড়েছিলাম।তারপরের দিন তুই খেলতে এসেছিলি আমি খেলিনি কথাও বলিনি চুপ করে বসেছিলাম।তুই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলি তাইনা?ছিঁচকাঁদুনী মেয়েটা আজ কাঁদছে না তো ঝগড়াও করছে না।কিছুক্ষণ থেকে তুই চলে গিয়েছিলি কিন্তু যাওয়াটা কেমন যেন অন্যরকমের ছিল,মনখারাপের যাওয়া।তারপরের দিন আবার তুই এসেছিলি কিন্তু আমি কথা বলিনি।তুই কিছুক্ষণ বসে থাকার পর একটা খুব সুন্দর উড পেনসিল বার করে বলেছিলি তোর জন্যে,আমি নেবনা নেবনা করে নিয়ে নিয়েছিলাম তুই খুব আস্তে বলেছিলি এবার ভাব তো ?আমি বলেছিলাম হাঁ আর সেই সাথে তোকে জব্দ করার রাস্তাও পেয়ে গিয়েছিলাম।ঝগড়া হলেই কথা বন্ধ করে দিতাম।তারপর আমাদের আস্তে আস্তে খেলা বদলালো,স্কুল বদলালো,বন্ধু বদলালো।আমরা বড় হতে শুরু করলাম কিন্তু অভ্যেস বদলালো না একটু রাগ হলেই আড়ি করে দিতাম সাথে কথা বন্ধ আর তুই ভাব করার জন্য অস্থির হয়ে উঠতিস।আজ তুই কত্তদূর,কতদিন দেখিনি তোকে।একবার আসবি?বিশ্বাস কর আমি পাল্টে গেছি আর আড়ি করবো না।



পুনর্মিলন
সূর্যস্নাত বসু

নদী থেকে কিছুটা জল তুলে নিয়েছি হাতের মুঠোয়
এখানে তরঙ্গহীন তুই ।
নদীতে তো আকাশ-ঢেউ খেলতি ।
নাম দিয়েছিল তার স্রোতস্বিনী ।
আজ হাতের মুঠোয় তুই স্রোতহীন নিরামিষ ,
কোটি কোটি স্তনবৃন্ত পারাপার হয়েছিল
তোরই বুক দিয়ে ,
তবে আজ তুই অচল
আমারই হাতে ,
আমারই মুঠোয়


যা যা , চলে যা ,
ধুয়ে নে নোংরা আমার ,

হাতের জল নদীতে ফেলে দিলাম ,



চলমান নদীতে আমার জল কোনটা ?



গোলাপী
রুমানিয়া ফারজানা


শামুকের মত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল গোলাপী
শকুনের বিষাক্ত ছোবল,তাকে করেছিল রক্তাক্ত.
সমাজের বখে যাওয়া লোকেরাতাকে যন্ত্রণা দেয় ,
এত অবহেলা,এত অপমান, আর নয়।
তাই সে স্থির করেছে বাঁচবেই ,
কীট পতঙ্গ এর মত নয়,মানুষ হিসাবেই।