উদ্ভাস

১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, অক্টোবর ২০১২

রাজর্ষি ঘোষ


নীল

একটা নীল আকাশের তলায় একটা নীল সাগর। আর তারই বুকে মুখ গুঁজে একটা ছোট্টো সাদা ঝিনুক। ঝিনুকটা ভীষণ ভালবাসত সাগরকে; বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়েছিল সে নীল সাগরের জল। সাগরও তার বিশালতায় ভালবেসে আশ্রয় দিয়েছিল ঝিনুকটাকে। সাগরের সাথেই ঝিনুকের খেলা... সাগরের সাথেই ঝিনুকের যত হাসি-কান্না, মান-অভিমান। আর সে কি হুটোপাটিটাই না করত দুজনে... একে অন্যের হাত ধরে টানাটানি, মারামারি, চুলোচুলি... কিন্তু, তাও দিনের শেষে ক্লান্ত ঝিনুক মুখ গুঁজে দিত সাগরের বুকে। কান্নার সুরে জিজ্ঞেস করত, আমায় ছেড়ে যাবে না তো? সাগরও একরাশ ঘোলাটে ভালবাসা চোখে টেনে নিয়ে বলত, পাগল? তোকে ছাড়া আমি বাঁচব নাকি?

ক্রমে ঝিনুক তার সবকিছু উজার করে দেয় সাগরের কাছে... দেহে টেনে নেয় সাগরের নোনা জল। নিজের রক্তে মেশায় সাগরের নীল। সেদিন রাতে কি কষ্টটাই না পেয়েছিল ঝিনুক... বুকের মাঝে আগুন জ্বলেছিল যেন। আর সেই আগুনে পুড়েছিল ঝিনুকের মনও। সারারাত অঝোরে কেঁদেছিল ঝিনুক... যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল সাগরকে বারেবার। ঝিনুকের কষ্ট দেখে সাগর তাকে বুকে টেনে নেয়, আদর করে বলে, আর কাঁদে না লক্ষীটি। এই তো আমি আছি তোমার পাশে। এই কান মুলছি দেখ, আর কখ্‌খ্‌নো তোমার সাথে দুষ্টুমি করব না। ঝিনুক নীল সাগরের মত নীল চোখ মেলে জিজ্ঞেস করে, সত্যি বলছ? আর সাগরও ঝিনুকের চোখের জল-টল মুছে, কপালে একটা ছোট্টো চুমু খেয়ে উত্তর দেয়, সত্যি সত্যি সত্যি... এই তিন সত্যি করলাম। কেমন, হল তো এবার?

তারপর একদিন ঝড় উঠল। সেদিনও সাগরের ঢেউয়ের সাথে লুকোচুরি খেলছিল ঝিনুক। ঢেউয়ের তালে কখনো ভাসে – কখনো ডোবে, কখনো ওঠে - কখনো নামে, আবার কখনো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে সাগরকে। সাগর খেলার ছলেই ঝিনুককে দূরে ঠেলে দিয়ে বলেছিল, যা তো দেখি কেমন লুকোতে পারিস। যত দূরে যাস, তোকে খুঁজে আমি বার করবই। কিন্তু, ঝিনুক সেই যে লুকোলো, আর ফিরল না। দমকা হাওয়া কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ঝিনুককে, সাগর তার আর খোঁজই পেল না।

সাগর কিন্তু চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখে নি। প্রবালে, শৈবালে, রঙ-বেরঙের মাছের ভিড়ে সে জিজ্ঞেস করে বেড়াল, আমার ঝিনুককে দেখেছ? তারা কেউ সত্যি ভালবাসায়, কেউ চিন্তায়, কেউ হিংসায়, কেউ মেকি সহানুভূতিতে, আবার কেউ নিছক কৌতূহলে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না তো। আমাদের ছোট্টো ঝিনুক? তুমি ওকে হারিয়ে ফেলেছ বুঝি? আমার কাছে তো লুকোয় নি এসে। দেখা পেলে ঠিক বলব, সাগর খুঁজছিল তোমাকে। সাগর চোখের জল মুছে বলে, বোলো কিন্তু।

সাগর ভাবল, এ সব ঝিনুকের শয়তানি। আমাকে শাস্তি দিতেই এমন জায়গায় লুকিয়েছে, আমার চোখ যার নাগাল পায় না। ঠিক আছে, থাকুক লুকিয়ে। খুঁজব না ওকে। ফিরে তো আসবেই। আবার হাসতে হাসতে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার বুকে। তখন দূরে সরিয়ে দেব। কথা বলব না সারাদিন। কিন্তু, ঝিনুক ফিরে এল না।

সারারাত গুমরে গুমরে কেঁদেছিল সাগর। বুকের যন্ত্রণা ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছিল জ্যোৎস্না-স্নাত বালুকাবেলায়, কালো পাথরের অন্ধকার কোণে। ফেনা হয়ে গর্জে উঠেছিল... চাঁদের আলোয় রূপোলি বালিকে আঁকড়ে ধরে ছটফট করেছিল সারাটা রাত। সেদিন সাগরের তান্ডবে কত যে নৌকাডুবি হল, কত যে হাজারে হাজারে লোক ঘরছাড়া হল, তার আর ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তাও একসময় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত সাগর শান্তি পেল নিজের শীতলতায়... ঘুমিয়ে পড়ল ঝিনুককে হারানোর দুঃখ বুকের মাঝে নিয়ে।

*************

সময় কেটে যায়। এখন সাগরের বুকে বাসা বেঁধেছে আরো নতুন কিছু ঝিনুক। তাদের কোনোটা লাল, কোনোটা হলদে, কোনোটা কালো, আবার একটা সাদাও। সাগর ঝিনুকগুলোকে নিয়ে সুখে আছে। ঝিনুকগুলো সারাদিন সাগরের সাথে লুকোচুরি খেলে... কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, আবার কখনো ভালবেসে মুখ লুকোয় সাগরের বুকে। সাগর ভালো আছে।

অনেকদিন পর, সোনালী বালুতটে খেলা করতে গিয়ে একটা সাদা ঝিনুক খুঁজে পায় দুটো নুলিয়া বাচ্চা। একটা ছোট্ট সাদা ঝিনুক... একলা... অসহায়... মৃত। বাচ্চাদুটো সাগরের মত নীল, অতল চোখে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখে, ঝিনুকটার স্খলিত, শিথিল আঁচলের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে একটা ছোট্ট মুক্তো। মুক্তোটার রঙ সাগরের মতই নীল।